১৩.১ মহাবিশ্বের তুলনায় পৃথিবীর বয়স
মহাবিশ্ব এখনো তার বিশালতা এবং বয়সের কারণে মানুষের সাধারণ বোধগম্যতার বাইরে একটি ক্ষেত্র। বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক তথ্যমতে মহাবিশ্ব আনুমানিক 13.৪ বিলিয়ন বছর আগে বিগ ব্যাং (Big Bang) নামে একটি ঘটনা থেকে শুরু হয়েছে। তার তুলনায় পৃথিবী অপেক্ষাকৃত নতুন একটি মহাজাগতিক বস্তু, যেটি প্রায় 4.6 বিলিয়ন বছর আগে গঠিত হয়েছিল। পৃথিবীর অশ্বমণ্ডল এবং ভূত্বক গঠিত হয়েছে প্রায় 400 কোটি বা 4 বিলিয়ন বছরের কিছু আগে। বিজ্ঞানীরা পৃথিবীর পাথর এবং খনিজগুলোর আইসোটোপের ক্ষয়ের হার (আইসোটোপ ডেটিং) পরীক্ষা করে আমাদের গ্রহের বয়স বের করে একটি টাইমলাইন বা সময়সীমা তৈরি করেছেন। যদিও মহাবিশ্বের বয়সের তুলনায় পৃথিবীর বয়স কম, তবুও তাদের বয়সের পার্থক্য পৃথিবীর অস্তিত্বকে আরও উল্লেখযোগ্য করে তোলে। আমাদের গ্রহের গঠনের রহস্য জানার জন্য এবং যেসব কারণে পৃথিবী জীবের বসবাসের উপযোগী হয়ে উঠেছে তা বোঝার জন্য পৃথিবী এবং মহাবিশ্বের বয়স সম্পর্কে জ্ঞান থাকা প্রয়োজন।
১৩.২ ভূতাত্ত্বিক সময়সীমা
রসায়ন অধ্যয়নে যেমন- পর্যায় সারণি, ভূগোল অধ্যয়নের ক্ষেত্রে যেরকম মানচিত্র একটা গুরুত্বপূর্ণ টুল হিসেবে ব্যবহৃত হয় ঠিক সেরকম পৃথিবীর ইতিহাস বর্ণনা করার সময় ভূতাত্ত্বিক সময়সীমা একটি অত্যন্ত প্রয়োজনীয় টুল বা পদ্ধতি হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এটি এমন একটি ব্যবস্থা যার মাধ্যমে পৃথিবীর ইতিহাসকে সময়ের ছোটো এবং বড় বিভিন্ন এককে সাজানো হয় (চিত্র ১৩.১)। আমরা সময় পরিমাপের ক্ষেত্রে বছর, মাস, সপ্তাহ, দিন, ঘণ্টা ইত্যাদি একক ব্যবহার করে থাকি। কিন্তু পৃথিবীর এবং মহাবিশ্বের ইতিহাস এত পুরোনো যে তা মাস বা বছর দিয়ে পরিমাপ করা অত্যন্ত দুরূহ এবং অনেক ক্ষেত্রে সম্ভব হয়ে ওঠে না। এছাড়া অনেক আগের ঘটনা শনাক্ত করাও সহজ নয়। সেক্ষেত্রে বিভিন্ন উল্লেখযোগ্য প্রাকৃতিক পরিবর্তনের উপর ভিত্তি করে বিভিন্ন ছোটো বড়ো এককে পৃথিবীর ইতিহাসকে ভূতাত্ত্বিক সময়সীমার মাধ্যমে বর্ণনা করা হয়।
১৩.২.১ ভূঅত্ত্বিক সময়সীমার একক
ভূতাত্ত্বিক সময়সীমাকে নিচের এককগুলোতে ভাগ করা হয়েছে। এখানে লক্ষণীয় যে, এই এককগুলোর মান সুনির্দিষ্ট নয়। পৃথিবীর গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার উপর নির্ভর করে কোনো একক কখনো অনেক বড়ো আবার কখনো তুলনামূলকভাবে ছোটো। এককগুলো এরকম:
কল্প বা ইয়ন (Em): এটি সবচেয়ে বড়ো একক। ভূতাত্ত্বিক সময়সীমায় প্রাচীনত্বের হিসেবে যথাক্রমে হেডিয়ান, আর্কিয়ান, প্রোটেরোজোইক এবং ফ্যানেরোজোইক এই চারটি কল্প বা ইয়ন রয়েছে। প্রতিটি ইয়ন কয়েকটি ইরা বা মহাযুগে বিভক্ত। ফ্যানেরোজোইক ইয়ন ছাড়া অন্য তিনটি ইয়নকে অনেক সময় প্রাক- ক্যামব্রিয়ান বলা হয়।
মহাযুণ ব্য ইরা (Era): এটি ভূতাত্ত্বিক সময়সীমার দ্বিতীয় বৃহত্তম একক। যেমন- বর্তমানে চলমান ফ্যানেরোজোইক ইয়নকে তিনটি ইরা বা মহাযুগে বিভক্ত করা হয়েছে। প্রাচীনতার দিক থেকে সেগুলো হচ্ছে প্যালিওজোইক, মেসোজোইক ও সিনোজোইক। প্রতিটি মহাযুগ আবার অনেকগুলো যুগ বা পিরিয়ডে বিভক্ত।
যুগ বা পিরিয়ড (Peried): মহাযুগের পরের একক হলো যুগ বা পিরিয়ড। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় মেসোজোয়িক মহাযুগকে প্রাচীনতার দিক থেকে ট্রায়াসিক, জুরাসিক ও ক্রিটেসাস এই তিনটি যুগে বিভক্ত করা হয়। প্রতিটি যুগ আলাদা ভূতাত্ত্বিক এবং জৈবিক ঘটনা দিয়ে চিহ্নিত।
উপযুন বা ঈণক (Epoch): যুগের পরবর্তী ছোটো একক হলো উপযুগ। যেমন- সর্বশেষ পিরিয়ড কোয়ার্টারনারিকে (quaternary) প্রাচীনতার দিক থেকে হোলোসিন এবং গ্লিস্টোসিন এই দুটি উপযুগে বিভক্ত করা হয়।
এছাড়া বিস্তারিতভাবে জানার জন্য প্রতিটি উপযুগ কয়েকটি পর্যায়ে (Stage or Age) বিভক্ত করা হয়েছে; যেমন- সর্বশেষ উপযুগ হোলোসিনকে প্রাচীনতার দিক থেকে গ্রিনল্যান্ডিয়ান (greenlandian), নর্থীগ্রপপিয়ান (Northgrippian) এবং মেঘালয়ান (Meghalayan) এই তিন পর্যায়ে ভাগ করা হয়।
এখানে ভূতাত্ত্বিক সময়সীমার বিভিন্ন এককের কয়েকটি উদাহরণ দেয়া হয়েছে। সময়সীমার চার্টে উল্লেখযোগ্য এককগুলো তাদের শুরুর সময়সহ সাজানো আছে যা থেকে আমরা সেই এককের মোট সময়কাল বের করতে পারি। লক্ষ করলে দেখা যাবে সকল যুগ, উপযুগ বা অন্যান্য একক সমান সময় পরিব্যাপ্ত করে না। এর কারণ হলো পৃথিবীর ইতিহাসে ঘটে যাওয়া বিভিন্ন উল্লেখযোগ্য ঘটনা দ্বারা এক একক থেকে অন্য একক পৃথক করা হয়। এসব বিশেষ ঘটনার মধ্যে রয়েছে কোনো এক বা একাধিক জীবের আবির্ভাব, পৃথিবীর প্রাকৃতিক পরিবেশের পরিবর্তন, বিভিন্ন জীবের গণবিলুপ্তি ইত্যাদি। ছবিতে পৃথিবী সৃষ্টি থেকে এখন পর্যন্ত পুরো সময়টিকে ঘড়ির বারোঘণ্টা সময় হিসেবে বিবেচনা করে দেখানে হয়েছে (চিত্র ১৩.২)। 4.6 বিলিয়ন বৎসরকে ঘড়ির বারোঘণ্টা হিসেবে ধরে নিলে পৃথিবীতে মানুষের আবির্ভাব হয়েছে মাত্র দুই সেকেন্ড আগে।
ভূতাত্ত্বিক সময়সীমা বা স্কেল একটি কালানুক্রম যা পৃথিবীর অতীত অধ্যয়ন এবং বোঝার একটি পদ্ধতিগত উপায়। এটি গুরুত্বপূর্ণ ভূতাত্ত্বিক এবং জৈবিক ঘটনার উপর ভিত্তি করে পৃথিবীর ইতিহাসকে প্রধান এককগুলোতে বিভক্ত করে। স্কেলটি প্রাক-ক্যামব্রিয়ান ইয়নের সঙ্গে শুরু হয়, যা পৃথিবীর গঠন থেকে জটিল জীবনের রূপের আবির্ভাব পর্যন্ত বিশাল সময়কে নির্দেশ করে।
প্রাক-ক্যামব্রিয়ান যুগের শেষে ফ্যানেরোজোইক ইয়নের শুরু হয়। এই ইয়নে প্যালিওজোয়িক মহাযুগের শুরুতে ক্যাম্ব্রিয়ান যুগে বৈচিত্র্যময় সামুদ্রিক জীবনের উত্থান ঘটে এবং পর্যায়ক্রমে গাছপালা এবং প্রাণীদের ভূমিতে বিস্তরণ এবং প্রাথমিক উভচর ও সরীসৃপের বিস্তার দ্বারা চিহ্নিত।
মেসোজোয়িক ইরা'কে, প্রায়ই 'ডাইনোসরের মহাযুগ' হিসাবে উল্লেখ করা হয়। এ সময় এই আকর্ষণীয় প্রাণীদের আধিপত্যের সঙ্গে সঙ্গে পাখি এবং সপুষ্পক উদ্ভিদের উন্মেষ ঘটে।
চিত্র ১৩.২: পৃথিবীর সৃষ্টি হয়েছে দুপুর বারোটায় এবং বর্তমান সময়কে রাত বারোটা কল্পনা করে বিভিন্ন ইয়ন এবং কয়েকটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা দেখানো হয়েছে। এই বারো ঘণ্টার ভিতরে ঠিক কয়টার সময় ঘটনাটি ঘটেছে সেটি ঘটনার নিচে দেখানো হয়েছে।
অবশেষে সেনোজোয়িক মহাযুগ যা প্রায় 6.5 কোটি বছর আগে শুরু হয়েছিল তা বর্তমান দিন পর্যন্ত অব্যাহত রয়েছে। স্তন্যপায়ী প্রাণীর উত্থান, মানুষের আবির্ভাব এবং আধুনিক বিশ্বের গঠন দ্বারা এই মহাযুগ বা ইরা'কে চিহ্নিত করা হয়।
১৩.২.২ ভূতাত্ত্বিক সময়সীমার গঠন ও পরিবর্তন:
ভূতাত্ত্বিক সময়সীমা পৃথিবীর প্রাচীন ইতিহাস সুসংবদ্ধভাবে অধ্যয়ন করার একটি পদ্ধতি। তবে এর গঠন প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে 17 শতাব্দী থেকে। সে সময় ড্যানিশ বিজ্ঞানী নিকোলাস স্টেনো (Nicolas Steno) একটি প্রস্তাবনা উপস্থাপন করেন। তার প্রস্তাবনা অনুসারে পাথরে যে সকল স্তর দেখা যায় তার সবচাইতে উপরের স্তরটি তুলনামূলকভাবে নতুন এবং ক্রমান্বয়ে যত নিচের দিকে যাওয়া যায় তত সেগুলোর বয়স বেশি হতে থাকবে। পাললিক শিলার ক্ষেত্রে বিভিন্ন সময়ে অবক্ষেপ জমা হয়ে এ সকল স্তর তৈরি হয়। এই প্রস্তাবনাটি উপরিপাত সূত্র (Law of Superposition) নামে পরিচিত। লক্ষ করলে দেখা যাবে ভূতাত্ত্বিক সময়সীমার বিভিন্ন এককগুলো উপরিপাত নীতি অনুসরণ করে সাজানো রয়েছে। এছাড়াও এই সময়সীমা ব্যবহার করে বিভিন্ন সময়ে সংঘটিত ঘটনাগুলো শনাক্ত করা যায়।
অসংখ্য বিজ্ঞানী এবং ভূতত্ত্ববিদ পরবর্তী কালে ভূতাত্ত্বিক সময়সীমার উন্নয়ন ও পরিমার্জন করেন। যেমন- আঠারো ও উনিশ শতকে ইংলিশ ভূতত্ত্ববিদ উইলিয়াম স্মিথ এবং স্কটিশ ভূতত্ত্ববিদ চার্লস লায়েলসহ আরও অনেকে পৃথিবী ইতিহাস উন্মোচনের ক্ষেত্রে ফসিল বা জীবাশ্মের গুরুত্ব উল্লেখ করেন। শিলার বিভিন্ন স্তরে প্রাপ্ত জীবাশ্ম অতীতের বিভিন্ন সময়ে প্রাণের অস্তিত্ব ও ধরন নির্দেশ করে। এই ধারণা থেকে ভূতাত্ত্বিক সময়সীমার প্রাথমিক কাঠামো গঠিত হয়। পরবর্তী কালে বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে যখন তেজস্ক্রিয়তা (Radioactivity) আবিষ্কৃত হয় তখন তা পৃথিবীর প্রাকৃতিক ইতিহাস সূক্ষ্মভাবে জানার ক্ষেত্রে এক বিপ্লবের সূচনা করে। বিভিন্ন শিলা বা খনিজ বা জীবাশ্মের বয়স বের করার ক্ষেত্রে ইউরেনিয়াম, কার্বন, স্ট্রনসিয়াম ইত্যাদি মৌলের তেজস্ক্রিয় আইসোটোপের তেজস্ক্রিয়তা ও রূপান্তর পর্যবেক্ষণ করা হয়। যার ফলে ক্রমাগত সংশোধন এবং নতুন তথ্য যোগ হয়ে ভূতাত্ত্বিক সময়সীমা বর্তমান রূপ ধারণ করেছে। এই প্রক্রিয়া এখনো চলমান এবং ভবিষ্যতে আরও নতুন গবেষণা ও প্রযুক্তি উন্নয়নের মাধ্যমে এটিতে আরও অনেক নতুন তথ্য যুক্ত হবে।
ভূতাত্ত্বিক সময়সীমা অধ্যয়ন করে, বিজ্ঞানীরা পৃথিবীর অতীত সম্পর্কে বিভিন্ন তথ্য উন্মোচন করতে পারেন। এছাড়া জীবনের বিবর্তন শনাক্ত করতে, ব্যাপক বা গণ-বিলুপ্তি শনাক্ত করতে, মহাদেশগুলোর স্থানান্তর বুঝতে এবং আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাত এবং উল্কাপিণ্ডের প্রভাবের মতো প্রাকৃতিক শক্তির প্রভাব পরীক্ষা করতে পারেন। ভূতাত্ত্বিক সময়সীমা বৈশ্বিক ঘটনাগুলোর ভেতর সম্পর্কগুলো জানার জন্য এবং ঘটনাগুলো বোঝার জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার হিসেবে কাজ করে এবং জীবাশ্মবিদ, ভূতত্ত্ববিদ এবং অন্যান্য বিজ্ঞানীদের পৃথিবীর সমৃদ্ধ ইতিহাসের পাঠোদ্ধার করতে সাহায্য করে।
১৩.২.৩ গণ-বিলুপ্তি (Mass extinctions):
বিলুপ্তি বলতে কোনো একটি জীব প্রজাতির সকল সদস্যের ধ্বংস বা নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়া বোঝায়। যেমন- ডাইনোসরের একটি প্রজাতি টাইরানোসোরাস রেক্স (T. Rex) এর সব সদস্য ধ্বংস হয়ে গেছে। তাই এই প্রজাতিটি বিলুপ্ত হয়েছে বলা যায়। একইভাবে বলা যায় যে, স্যাবারটুথ টাইগার নামে এক ধরনের বাঘ বিলুপ্ত হয়ে গেছে এবং যার ফলে এখন একটিও জীবিত স্যাবারটুথ টাইগার খুঁজে পাওয়া যাবে না। গণ-বিলুপ্তি হলো টাইরানোসোরাস রেক্স এবং স্যাবারটুথ টাইগারের মতো আরও হাজার হাজার প্রজাতি একসঙ্গে ধ্বংস হয়ে যাওয়া। পৃথিবীর ইতিহাসে এখন পর্যন্ত অন্তত পাঁচটি গণ-বিলুপ্তির ঘটনা ঘটেছে। যেমন- এখন থেকে প্রায় 6.6 কোটি বছর পূর্বে ক্রিটেশাস-পেলিওজিন গণ-বিলুক্তির ঘটনা ঘটে। সে সময় ডাইনোসরসহ পৃথিবীর মোট জীব প্রজাতির অন্তত 75 শতাংশ বিলুপ্ত হয়ে যায়। এই গণবিলুপ্তি দ্বারা মেসোজোয়িক মহাযুগের সমাপ্তি এবং সিনোজোয়িক মহাযুগের সূচনার সীমানা নির্ধারণ করা হয়।
আবার উল্টো ঘটনাও রয়েছে। যেমন- আজ থেকে প্রায় 54 কোটি বছর আগে পৃথিবীতে প্রচুর নতুন প্রজাতি এবং জটিল (Complex) ধরনের প্রাণের আবির্ভাব ঘটে। এই ঘটনার মাধ্যমে ক্যামব্রিয়ান যুগের সূচনা চিহ্নিত করা হয়। অতি প্রাচীনকালের এসব তথ্য মূলত জীবাশ্ম পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে জানা যায়।
১৩.৩ জীবাশ্ম (Fossils):
অতীতে বসবাসকারী যে কোনো জীবের (উদ্ভিদ বা প্রাণী) দেহাবশেষ বা দৈহিক গঠনের অথবা বসবাসের যে কোনো চিহ্ন জীবাশ্ম হিসেবে অভিহিত করা হয়। ল্যাটিন শব্দ 'Fossus' থেকে ফসিল (Fossil) শব্দটির উৎপত্তি হয়েছে। জীবাশ্ম বিভিন্ন ধরনের হতে পারে, যেমন- হাড়, দাঁত, দেহের বাইরের শক্ত খোলস, এমনকি অবক্ষেপ বা পাথরের মাঝে জীবের দেহের যে কোনো চিহ্ন জীবাশ্মের মধ্যে পড়ে। জীবাশ্ম বিভিন্ন আকারের হতে পারে, অতি ক্ষুদ্র এককোষী ব্যাকটেরিয়া থেকে শুরু করে বিশালাকার ডাইনোসর বা গাছের অংশ ফসিল আকারে পাওয়া গিয়েছে। সাধারণত কোনো জীবের ফসিল হতে হলে তার চিহ্ন বা দেহাবশেষ কমপক্ষে ১০ হাজার বছরের পুরোনো হতে হয়। এছাড়া সবচেয়ে পুরোনো জীবাশ্মের মধ্যে রয়েছে ৩৫০ কোটি বছরের পুরোনো এককোষী সায়ানোব্যাকটেরিয়া যা Stromatolites নামে পরিচিত। জীবাশ্মের ধরনগুলো নিম্নরূপ হয়ে থাকে:
চিত্র ১৩.৩: গাছের আঠায় আটকে পড়া একটি ভিমরুল যা আজ থেকে 2.0-1.5 কোটি বছর আগে পৃথিবীতে ছিল।
১৩.৩.১ বডি জীবাশ্ম (Body Fossil):
এক্ষেত্রে কোনো জীবের সম্পূর্ণ বা আংশিক দেহাবশেষ জীবাশ্ম আকারে পাওয়া যায়। যেমন- বরফে জমে থাকা আদি মানবের মৃতদেহ অথবা লোমওয়ালা হাতির (Mammoth) মৃতদেহ, গাছের আঠা বা কষে আটকে পড়া পতঙ্গ ইত্যাদি। পরবর্তী কালে গাছের আঠা জমে তা অ্যামবারে (Amber) পরিণত হয় এবং তার মাঝে আটকে পড়া জীবদেহ প্রায়শ অক্ষত থাকে (চিত্র ১৩.৩)।
১৩.৩.২ মোন্ড এবং কাস্ট জীবাশ্ম (Mold and Cast) :
অনেক ক্ষেত্রে কোনো জীবের দেহাবশেষ যে অবক্ষেপে (Sediment) চাপা পড়ে তা সময় প্রবাহের সঙ্গে সঙ্গে পাললিক শিলায় পরিণত হয়। পরবর্তী কালে জীবের দেহাবশেষ ক্ষয় হয়ে গেলেও তার ছাপ সেই শিলায় থেকে যায়। এগুলোকে মোল্ড বা ছাঁচ বলা হয়। মোল্ড বা ছাঁচের ভেতরের ফাঁকা অংশ যদি পুনরায় অবক্ষেপ দ্বারা পূর্ণ হয়ে শক্ত হয়ে যায় এবং দেখতে সেই জীবের দেহের মতো হয় তখন তা কাস্ট জীবাশ্মে পরিণত হয় (চিত্র ১৩.৪)।
১৩.৩.৩ ট্রেস জীবাশ্ম (Trace Fossils):
কখনো কখনো জীবের বসবাসের বা চলাচলের বিভিন্ন চিহ্ন পাললিক শিলায় বা অবক্ষেপে পাওয়া যায়। যেমন- পায়ের ছাপ, চলাচলের ফলে সৃষ্ট পথ, বসবাসের গর্ত, তৈরি বাসা ইত্যাদি ।
১৩.৩.৪ পারমিনারালাইজড
জীবাশ্ম (Permineralized Fossil):
অনেক ক্ষেত্রে মৃত জীবের দেহের শক্ত অংশের ভিতর ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ফাঁকা স্থান বা ছিদ্রসমূহ খনিজ দ্বারা (সাধারণত পানিবাহিত) পূর্ণ হয়ে যায় এবং সেই জীবের দেহের আকার ও আকৃতি সংরক্ষণ করে। কখনো কখনো সেই খনিজ জীবের টিস্যুর উপাদানকে প্রতিস্থাপন করে ফেলে। এ ধরনের জীবাশ্মের একটি উদাহরণ হলো প্রস্তরীভূত গাছ (চিত্র ১৩.৬)।